কখনো বাসে- কখনো রিকশায়। মটর সাইকেল কিংবা ভ্যান । আবার কখনো পায়ে হেটে,কখনো বা নদী পথে— অবিরাম ছুটে চলা— সঙ্গী ক্যামেরা, সেলুলার আর ডাইরি । এই সব নিয়ে আমার—ছোট ছোট কথা . . .

তেজগাওঁ রেলওয়ে বস্তির মধ্য দুপুর। খবর রটে যায় বস্তি উচ্ছেদের । চারিদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি,কান্না আর ভাঙ্গনের শব্দ- আতংকিত মানুষের ছুটোছুটি। ৬৫ বৎসরের বৃদ্ধা শহরবানু দিশেহারা হয়ে পড়েন। নিজের ঝুপড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে নাতনির হাত ধরে রেল লাইনের উপর বসে পড়েন। স্বামীর হাত ধরে বেঁচে থাকার জন্য গ্রাম ছেড়ে ছিলেন সেই কবে—আজ আর মনে নেই। স্বামী হারা হয়েছেন দীর্ঘদিন। এখন সন্তানই একমাত্র ভরসা ! তেজগাওঁ এর এই ঝুপরিতেই দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। আজ রেল লাইনের উপর বসেই দেখলেন, তার ঝুপড়ি ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হলো ! শহরবানু নিজের মনেই বলে উঠেন, খোয়াবের শহর ! স্বামী হারা হইছি এই ঢাকা শহরে আইস্যা,মরলে এই হানেই মরুম ! ততোক্ষণে হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছুটে আসে । ট্রেনের খট খট শব্দে শহরবানুর কথা মিলিয়ে যায় বাতাসে . . .
কামরাঙ্গীর চর তখন সকাল দশটা। হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়-আপনাদের প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নিন। এখনই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। চরবাসী রাজ্যের শক্তি নিয়ে যেন নেমে পড়ে। মাটির চুলা,থালাবাটি,ছটি ঘরের সন্তান, ঘরের বেড়া,প্রিয় ছাগল/মুরগীর খামার,আজমীর শরীফ, শাবনুরের পোস্টার আর বেঁচে থাকার সব অবলম্বন নিয়ে চরের সড়ক ধরে দৌড় দিতে হয়। বুলডোজারটি পিছন পিছন ছুটে আসে। কারো কারো শেষ রক্ষা হয়ে উঠে না। গ্রাম থেকে চলে আসা ভিটেহীন এসব মানুষের- শহুরে বস্তিতেও ঠায় হয় না। প্রিয় মানুষ,বৃদ্বা মা আর সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছুটতে হয়। তারপর ক্লান্ত শ্রান্ত ছোট দেহটি খোলা আকাশের নিচে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে . . .
তেজগাওঁ পুরান এয়ার পোর্ট এলাকা তখন বিকেল ভর করেছে। আশ্রয়ের সব কিছু তখন মাটির সাথে মিশে আছে। জীবিত মানুষ গুলো শুধু বেঁচে আছে-বেঁচে থাকতে হবে বলে ! আট মাসের ময়না-খোলা আকাশের নিচে খড়খুটোর মধ্যে শুয়ে থেকে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত। এই শীতের বিকেলে তার যেন কোথায় থাকার কথা ছিল তার ? আর ঐ দিকে ময়নার বাপ- মেয়েকে জন্ম দিয়েই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে—সেই কবেই। অথচ অনেক শখ করে ময়নার বাপের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে ছিল শিউলি— জুয়ার শহর এই ঢাকা বস্তির ঐ ঘরটাই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাএ ঠিকানা। ময়নার বাপের জন্য অপেক্ষার ঠিকানা হারিয়ে শিউলি এখন নির্বাক। শুন্য আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর ভাবে পরের রাতটা কোথায় কাটাবে . . .
শ্যামপুর গাজীর হাট এলাকায় তখন সকাল। মমতা বেগম কাখের কলসি ফেলে ছুটে আসে- তার ঘর বাঁচাতে ! সরকারের জায়গাতেই চারশত টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতেন বাপ মরা মেয়েটিকে নিয়ে। সারা দিন দোকানে দোকানে পানি টেনেই চলতো তাদের দুই জনের সংসার । এক পা ভাঙ্গা— চৌকিটা নিজেই একা টেনে বের করার চেষ্টা করেন,আর বিলাপ করতে থাকেন। ঐ দিকে আতংকে ছুটতে থাকে মেয়ে বাহারজান ! তার জীবনে এটাই প্রথম উচ্ছেদ হওয়া। মা/মেয়েরে কান্নায় গাজীর হাটের বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও—বুলডোজারটি ঠিকই গুড়িয়ে দেয় ওদের ঘর ! ছাপড়া ঘর আর পা ভাঙ্গা চকিটি মমতা বেগম অনেক আকুতি করেও শেষ রক্ষ করতে পারে না । মমতা বেগম নিজের মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শান্তনার সুরে বলেন-আমাগো আল্লাই দেখবো মা . . .
পুরান ঢাকা ,আগস্ট, ২০০৭