সত্য এবং সুন্দরের গল্প . . .

স্কেচটি করেছে ক্ষুদে শিল্পী : আদিবা

গাইবান্দা শহরে এসেও দেখা হলো না শহুরে নদী—ঘাঘট’কে ! ইচ্ছা ছিল ঘাঘটের জলে সূর্য্যস্ত দেখবো। দেখবো—নদী পাড়ে মানুষের জীবন বৈচিত্র ! বাস থেকে নেমে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি । একজন রিকশা চালক আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোনটে যাবে বাহে ? আমি রিকশা চালকের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম—তিন গাছ তলা, কলেজ রোড, রাধাকৃষ্ণপুর । হামাক রিকশাত চল ! আমি রিকশাতে উঠে পড়লাম। রিকশা চালক মকবুলের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাই, কলেজ রোডের দিকে। 

তিন মেয়ে আর এক ছেলের জনক, মকবুল পুরো পরিবার নিয়ে এই শহরেই থাকেন । রিকশা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেন । ব্যাটারি চালিত রিকশার জমা ১৫০ টাকা । জমা বাদ দিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়, কখনো আরো কম,তবু সংসার চলে যায়—চালিয়ে নিতে হয় ! দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুই জন স্কুলে পড়ে । কথা প্রসঙ্গ জানা গেল, তার তিন মেয়ের পড়াশোনার মাথা ভালো, অভাবের কারণে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। 

শহরের এই প্রান্তে বর্ষা মৌসুমে বন্যা না হলেও, পূর্বপাড়ে শহরকে প্রতি বছর ডুবিয়ে দেয়—বন্যার পানি ! আর তখন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পরে— কষ্ট বারে, জানালেন মকবুল। সংগ্রামী মানুষগুলো প্রকৃতির নিয়মে তা আবার সামলে উঠেন—জীবন চলে যায় ! 

তিন গাছ তলা—নামটা শোনার পর থেকে জায়গাটা, কেন তিন গাছ তলা নাম রাখা হলো, তা জানার আগ্রহ বেড়ে গেল ! যদিও আমার গন্তব্য এই ‘তিন গাছ তলা’ রিকশা চালক মকবুল ভাইকে আমার আগ্রহের কথা বলি—সে আমাকে জানান দেন, এই এলাকায় আগে তিনটা বট গাছ ছিল । এক সাথে জড়াজোড়ি করে ওরা থাকতো । ঐ বটগাছ তলায় মানুষের নানা— মিলন মেলা হতো । যদিও সেই বট গাছের দুটি গাছ, এখন আর আর নাই ! তবে নানা প্রতিকুলতা সহ্য করে এখনো টিকে আছে, ওদের একটি । ঐ গাছ গুলোর অবস্থানের কারণে এলাকাটির নাম হয়ে গেছে—তিন গাছ তলা । আমি তার কথা শুনে বললাম, বাহ ! বেশ মজার ইতিহাস । কিন্তু দুটো গাছ কেন কাটা হলো ? এর উত্তর মকবুল ভাই, দিতে পারলেন না । 

তিন গাছ তলা—গাছের নিচ দিয়ে আমাদের রিকশা যেতে যেতে,বেশ কিছু দোকান আমার চোখে পড়ল, সেইসব দোকান গুলোতে বসে লোকজন আড্ডা দিচ্ছেন, চা খাচ্ছেন, টেলিভিশন দেখছেন । তাদের মাথার উপর বেঁচে থাকা, সেই তিন গাছের—একটি গাছ দাঁড়িয়ে ! আমি তাকে দেখলাম, মনে মনে অভিবাদন জানালাম । খুব ভালো লাগলো এই জায়গাটা । অনেকটাই—নির্জন চারিদিকে সবুজ আর সবুজ ! আরো একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল, একটা পূজা মন্ডপ। লোকজন বসে আছে, ঢাক বাজানো হচ্ছে—শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মালম্বীদের শারদীয় দুর্গাপুজা । মকবুল ভাইকে, বিদায় জানিয়ে আমি, আমার গন্তব্যে ছুটলাম । 

গাইবান্ধা নামকরণ ঠিক কবে নাগাদ হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে একটা মজার কিংবদন্তী রয়েছে এই নামকরণে ! নানা তথ্য থেকে এবং এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়—আজ থেকে প্রায় ৫২০০ বছর আগে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় —বিরাট রাজার রাজধানী ছিল। বিরাট রাজার প্রায় ৬০ (ষাট) হাজার গাভী ছিল। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। সেজন্য বিরাট রাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে—গো-শালা স্থাপন করেন। গো-শালাটি ছিল সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে তা নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন করা হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে গাভীগুলোকে বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এই গাভী বেঁধে রাখার স্থান থেকে এতদঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে—গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে।

কাজ শেষ করে গাইবান্দা থেকে ঢাকায় ফিরলাম । আমাদের ক্ষুদে শিল্পী—আদিবা’কে বলালম, তুমি আমাকে, ‘তিন গাছ তলা’ একটা ছবি একে দাও তো ! যেখানে তিনটা বট গাছ থাকবে, একটা সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ । সে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে,তার মতো করে একটা স্কেচ করে দিল—আমাকে। আদিবার আঁকা এই স্কেচটি এখানে ব্যবহার করলাম । 

ঘাঘট—নদীর জলে সূর্য্যস্ত দেখতে যেতে হলেও, একবার যেতে চাই সেখানে । যেমনটা সাদা পাহাড়ের দেশ, বিরিশিরির গিয়েছিলাম, সেখানে সোমেশ্বরী নদীতে দেখেছিলাম— সূর্য্যস্ত আর সেইসব মানুষের দৈনন্দিন জীবন . . .

পাতলা খান লেন, পুরান ঢাকা

অক্টোবর ২০১৬

Leave a comment