বাবা—আমার ঘুম পাচ্ছে ! তখন রাত হয়ে গেছে, আমি মেঘ’কে নিয়ে মটরসাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরছি । আমি বললাম, বাবা—আমরা চলে এসেছি, আর একটু পরেই বাসায় ঢুকবো । মেঘ বলে—বাবা, জানো আমার কেন ঘুম পাচ্ছে ? আমি বললাম, না—সে বলে আমিতো আজ দুপুরে ঘুমাই নাই—তাই ঘুম পাচ্ছে !
আজ মেঘ আর আমি মটরসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম । সে বলে তোমার মটর সাইকেলে অনেকদিন আমি ঘুরতে বের হই না ! গিয়েছিলাম বেগম রোকেয়া এভিনিউ সড়কের বিসিএস কম্পিউটার সিটিতে । ক্যাননের মামুন ভাইয়ের সাথে একটা কাজ ছিল । মটর সাইকেলে যেতে যেতে বাপ-বেটা মিলে নানা কথা বলছিলাম ।
সাপ্তাহিক দিনটি বৃহস্পতিবার থাকায় সড়কে যানজটের অবস্থা ছিল যথারিত— ভয়াবহ ! কম্পিউটার সিটিতে কাজ শেষ করে বেড়িয়ে পড়লাম । আমাদের এখন গন্তব্য শিল্পকলা একাডেমী— প্রথম আলোর তরুণ আলোকচিত্রীদের শরনাগত—বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা শীর্ষক আলোচিত্র প্রদর্শনী দেখা । প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখা হলো সুমন ইউসুফ, আশরাফুল আলম আর আবদুস সালামের সাথে । প্রদর্শনী নিয়ে কথা হলো ওদের সাথে ।
প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন—ফটোসাংবাদিক আবীর আবদুল্লাহ । প্রদর্শনীর ছবি গুলো দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে—দৈনিক সংবাদপত্রের জন্য এটা—এক ধরনের ডকুমেন্টেশন বা প্রামানিক দলিল । যদিও এই তরুণ ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে আরও শক্তিশালী কাজ আশা করছিলাম ।
ফটোসাংবাদিকদের সব সময় একটা চাপের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয় । সময় মতো ঘটনাস্থলে পৌছান, সঠিক অবস্থান নেওয়া, সঠিক ছবিটি তুলতে পারার পাশাপাশি তা সময় মতো অফিসে পাঠানো, পুরো প্রক্রিয়াটি একটা বড় মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে— যা কাজ করতে করতে নিজের মধ্যে গড়ে উঠে ।
সময় উপযোগী প্রদর্শনীটির জন্য আয়োজক প্রথম আলো পত্রিকা, প্রদর্শনীর কিউরেট আবীর আবদুল্লাহ এবং সকল ফটোসাংবাদিকদের আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই . . .
গত রাতে ঝড়ো বৃষ্টি হয়েছে । সেই সাথে মেঘের গর্জন আর ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো—কালবৈশাখী ! মেঘ বলল, বাবা আমার স্কুলে আগামীকাল বাষির্ক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আছে, সকালে কি বৃষ্টি থাকবে ? আমি বললাম জানি না বাবা, দেখা যাক কি হয়, তুমি এখন ঘুমাও। সে একটু পরে আবার বলে, বাবা— আমিতো যেমন খুশি তেমন সাজোতে, নাম দিয়ে এসেছি—আমি গাছ সাজবো ! আমি বললাম বাবা ঠিক আছে । তুমি এখন ঘুমাও ।
বৃষ্টি ভেজা সকাল—খুব চমৎকার রোদ চারপাশে ! দেখেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল ! মেঘ বেচারা খুব টেনশন করছিল, সে সকালে স্কুলে যেতে পারবে কিনা ? সকালে যদি বৃষ্টি হয় ! সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা তিন জন রিকশাতে রওনা করলাম সঙ্গে মেঘের—গাছ বন্ধু ! মা-বেটা মিলে খুব সুন্দর করে এই গাছ বানিয়েছে, কাগজ কেটে কেটে—তাতে রঙ করা হয়েছে । মেঘের সেকি আনন্দ ! আজ সে তার স্কুলে— গাছ বন্ধু হয়ে ঘুরে বেড়াবে, তার অন্য সব বন্ধুদের সাথে । তার ফুপিকে বলছে সে গাছ সাজবে তার স্কুলে ।
সেন্ট টমাস মিশন প্রাইমারী স্কুলটিতে প্রবেশ করতেই, মনটা ভরে গেল অন্য রকম—এক আনন্দে ! সকালের মিষ্টি রোদে ভরে আছে মাঠ । চারপাশের গাছ গুলো—বৃষ্টি ভেজা ! আর মূল চার্চটি যেন—খুব নির্বাক ! সেই কতোদিন—কতোদিন দিন তার বুকে ঘড়ি এটে দাড়িয়ে আছে নিরবে । এখানকার মানুষ এখনো—সেই ঘড়ি দেখে পথ চলে ! সময় সময় ঘন্টা বাজিয়ে সময়ের জানান দেয়—সেই চার্চের দেয়াল ঘড়ি ।
ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে— পরনে তাদের স্কুল ড্রেস হাতে লাল ফিতে বাঁধা । আমার কাছে খুব ভালো লাগলো, লাউড স্পিকারে— একটার পর একটা রবীন্দ্র সংঙ্গীত বাজছিল । আমার হিয়ার মাঝে / আমার পরানো যাহা চায় / আমি মুগ্ধ হয়ে সেই গানগুলো শুনছিলাম ।
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা উপস্থিত অতিথিদের অব্যর্থনা জানিয়ে একটু পর ঘোষণা দিলেন—তাদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার । উপস্থিত অতিথীরা ক্ষুদে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে সুন্দর সুন্দর কথা বললেন।
শুরু হলো—বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান । বিভিন্ন শ্রেনীর ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের একটা জায়গায় বসানো হয়েছে । সেখান থেকে ক্লাস অনুযায়ী ডাকা হচ্ছে, খেলা গুলোতে অংশ গ্রহনের জন্য । প্রতিযোগিতা গুলো ছিল বেশ মজার । যেমন— জুতা-মোজা দৌড়,আলু তুলে দৌড় , অংক দৌড় ,মটরসুটি দৌড়,ভারসাম্য দৌড়। ব্যাঙ লাফ, হাঁস হাঁটা, চকলেট দৌড় সহ নানা আয়োজন ।
আমরা অভিভাবকরা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের এই সব খেলা দেখে—খুব মজা পেলাম । এরই মধ্য ছোট ছোট এই মানুষ গুলো যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা অংশ নিয়ে সারা মাঠ ঘুরতে লাগলো । কেউ সেজেছে — বঙ্গবন্ধু , কেউ কৃষক, কেউ মুক্তিযাদ্ধা, কেউ কমান্ডার,আবার কাউকে দেখা গেল ডাক্তার সেজে ঘুরে বেড়াতে; কেউ সেজেছে কৃষ্ণ কিন্তু রাধা’কে দেখা গেল না, আবার কেউ শিক্ষিকা সেজেছে, কেউ বা উকিল । মেঘ তার গাছ নিয়ে গাছ বন্ধু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—মনের আনন্দে ।
একটু পরে শিক্ষার্থীদের টিফিন দেয়া হলো । এর পর পর অভিভাবক এবং শিক্ষকদের জন্য একটা প্রতিযোগিতা ছিল । সেটাও খুব মজা হলো । প্রতিযোগিতার শেষ পর্ব ছিল পুরষ্কার বিতরণ ।
এবার মাইকে ঘোষণা এলো — ব্যাঙ লাফে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছেন, নিরব মিয়া ! আমি ছোট নিরব মিয়াকে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলাম ! এরই মধ্য মাইকে ঘোষণা এলো মেঘের নাম— সে যেমন খুশি তেমন সাজোতে—প্রথম পুরষ্কার পেয়েছে !
বেটা’তো আমার মহা খুশি, সে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছে ! আমি মেঘ’কে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম । আমি মেঘ’কে বললাম, তোমার স্কুল’তো আমাকেও একটা পুরষ্কার দিয়ে দিল । মেঘ বলল, আমি দেখেছি—তুমি বেলুন ফুটানো’তে ২য় হয়েছ । এবার আমাদের বিদায়ের পালা, স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ীর পথে রিকশা নিলাম, সঙ্গে দুটি পুরষ্কার আর গাছ বন্ধু . . .
Today’s 16 December , 2016 my dear younger brother SHUVO is now married person.We pray both of you Shuvo & Arpeeta and thank you so much for your beautiful moments sharing with us.
You know the together you are stronger, together you are one.Our wishes with pray, love & happiness.Have a wonderful married life! Megh,Bubli & your Choto Bhaiya.
নোট : বাবার এই ছবিটি পুরান ঢাকার কালাম ষ্টুডিও থেকে তোলা ।বাবা—তোমাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করে ! কত দিন যে তোমাকে দেখি না ! বুকের মধ্য খুব কষ্ট হয় ! একা একা নির্জনে কেঁদে ফেলি ! আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি—সেখানে অসীম শূন্যতা দেখি ! বাবা— কেন যে তোমার উপর বারবার এতো অভিমান হয় আমার—জানি না । আমি কাউকে বোঝাতে পারিনা . . .
আজ ২০ ডিসেম্বর আমার বাবার ২৬তম মৃত্যু বাষির্কী । ১৯৯০ সালের এই দিনে বাবা, না ফেরার দেশে চলে যান । সে দিনের সংবাদটা আমরা ফোনে পেয়েছিলাম । আমি তখন বাসাতে ছিলাম, ঠিক সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফোন আসে । ফোনটা আমার মা রিসিভ করেন—ও প্রান্তের কথা ঠিক বুঝতে না পেরে আমাকে ফোনটা দেন। আমি কথা বলে ততোক্ষণে বুঝে গেছি; আমরা—আমাদের প্রিয় বাবাকে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছি। সে আর কোন দিন ফিরে আসবে না আমাদের পরিবারের মাঝে । আহা ! আমার প্রিয় বাবা !
বাবা ব্রেন ষ্ট্রোক করেছিলেন । সে দিন হাইকোর্টে তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান ছিল । সেখানে অংশ গ্রহণ শেষে মতিঝিল এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই মাগরিবের নামায পরার সময় অসুস্থ বোধ করেন; অতপর সেখানে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ।
ছোট মেঘ তার দাদা’কে দেখেনি। তাঁর কাছে, তার দাদা মানে ফ্রেমে বাঁধানো এক খানা সাদাকালো ছবি—তার দাদীর কাছে থেকে শোনা নানা কথামালা । জনসন রোডের কোর্ট এলাকার সামনে দিয়ে গেলেই—মেঘ আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, বাবা এটা কি দাদার অফিস ছিল ? আমি তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কে বলেছে তোমাকে— মেঘ বলে দাদী বলেছে । আমি বলি, হ্যাঁ এটা তোমার দাদার অফিস ছিল । আমরা তিন ভাই-বোন মিলে এখানে বেড়াতে আসতাম ছুটির দিনে । বাবা যখন—এই ঢাকা আইনজীবি সমিতির ( ১৯৮২-৮৩) সেক্রেটারি ছিলেন,তখন এখানে খুব আসা হতো নানা অনুষ্ঠানে ।
আমাদের বাবা—আমাদের গ্রামের বাড়ী হিজুলিয়াতে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন সঙ্গে তার বাবা-মা । বাবা আপনি ভালো থাকবেন । আমাদের বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন . . .
16 December 2016 Dhaka, Bangladesh ~ Today’s my dear younger brother SHUVO is now married person.We pray both of you Shuvo & Arpeeta and thank you so much for your beautiful moments sharing with us.You know the together you are stronger, together you are one. Our wishes with pray, love & happiness.Have a wonderful married life!
সেদিন বাপ-বেটা মিলে শাখারী বাজার গিয়ে একটা ঘুড়ি কিনে নিয়ে আসলাম । সে লাল-সবুজের পতাকাওয়ালা ঘুড়ি কিনবে, ওটাই তার পছন্দ । মেঘ কে বলালম, মেঘ এই সেই শাখারী বাজার যেখানে ভারতীয় একজন ফটোগ্রাফারের তোলা বিখ্যাত একটা ছবি আছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দুইজন গেরিলা অস্ত্র উচিয়ে শাখারী বাজারে প্রবেশ করছেন, আমার খুব পছন্দের ছবি । তারপর কিশোর পারেন সম্পকে যতোটুকু জানি তা মেঘকে বলালম—
কিশোর পারেখ (১৯৩০-১৯৮২) একজন ভারতীয় ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের নানা দেশের নামী-দামী পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক ও ফটো সাংবাদিক অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদের মধ্যে পারেখ ছিলেন ব্যতিক্রম যিনি কোন অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। মাত্র ৮ দিনে তাঁর তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন। ভারত সরকার তাঁর ছবি দেখে বইটির ২০ হাজার কপি অর্ডার দেন । তথ্য সুত্র : সামহোয্যার ইন ব্লগ ।
মেঘ সেই ঘুড়ি পেয়ে মহা খুশি ! সেদিন বিকেলে আমাদের ছাঁদে ঘুড়ি উড়ালাম—নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় লাল-সবুজের সেই ঘুড়ি !
মনে পরে গেল কৈশরে সেই সব স্মৃতি । পাতলা খান লেনে আমরা ছাদে ছাদে কতো ঘুড়ি উড়িয়েছি, পৌষ সংক্রান্তির প্রস্তুতি আর সবাই মিলে অফুরন্ত সেই আড্ডা !
বিজয় দিবসে আগের দিন রাতে আমাদের ছাঁদে ছোট ছোট কাগজের পতাকা দিয়ে সাজিয়ে—বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি । বন্ধুরা মিলে বিজয় দিবসে ঘুরতে বেড়িয়েছি । চন্দনের গাড়ীতে করে ঘুরতে বেড়িয়ে রেনেসাঁ ব্যান্ডের একাত্তরের রেনেঁসা অ্যালবামের ( ১৯৯৮ ) সেই গান গুলো খুব শুনতাম । এখন সেই সব শুধু স্মৃতি । এখন ছোট মেঘ’কে নিয়ে বিজয় দিবস উদযাপন করি ।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশে’কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়—পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে । স্বাধীনতার জন্য সাধারন মানুষের যে সর্বাত্মক জনযুদ্ধ ও আত্মত্যাগ করে লাল-সবুজের ভুখন্ডের জন্ম তার প্রতি এবং তাদের প্রতি যথাযথ সন্মান দেখানো ।