
সকাল বেলা বুবলী আমাকে জানালো—নানী মারা গেছেন ! আমি মা’র রুমে গেলাম ; দেখি মা সোফায় বসে কান্না-কাটি করছেন | বড় মামা ফোন করে জানিয়েছেন — তাদের মা আর নাই ! আমি ছুটলাম ওয়ারীর সালাউদ্দিন হাসপাতালে | নিথর দেহটা এক পাশে কাত হয়ে আছে; দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছেন ! নানী মারা যাবার সময় বড় মামা-মামী উপস্থিত ছিলেন | মামার কোলেই নানী শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ! দিনটি ছিল—২৬ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা| নানী অসুস্থ হবার পর আমার এই বড় মামা-মামী সারাক্ষণ নানীর সেবা যত্ন করতেন |
নানীর সাথে আমার খুব একটা দেখা হতো না | অযুহাত হলো— সময় এবং ব্যস্ততা | কিন্তু নানী ঠিক খোজ-খবর রাখতেন সবার, তার নাতি-নাতনি আর নাত বউদের,তাদের সন্তানদের | নানীর বাসায় গেলে আমাদের জমিয়ে আড্ডা হতো| এই নানীর বাসাকে কেন্দ্র করে আমার ছোট বেলায় বেড়ে উঠা | স্কুল ছুটি শেষে আমরা নানীর বাসায় যেতাম,বাসার পিছনে বেশ কিছু ফলের গাছ ছিল—ছিল খেলার জায়গা; সেখানে আমরা বন্ধুরা মিলে খেলা-ধূলা করতাম |
ছোট বেলায় নানীকে খুব ভয় পেতাম | বড় হয়ে সেই নানী বন্ধু হয়ে গেল—হয়ে গেল প্রিয় মানুষ | নানী আমার বাবা’কে কখনো জামাই বলতেন না, বলতেন—তোর বাপ হইলো আমার আর এক—বেটা | আমার বাবা’কে সে খুব ভালোবাসতেন | প্রচন্ড ভালোবাসতেন তার বড় নাতিকে ( আমার বড় ভাই ) এই পরিবারে তাদের বড় নাতি ছিল—মধ্যমনি | বড় নাতিও ছিল নানা-নানীর অন্ধ ভক্ত |
নানী মারা যাবার এক সপ্তাহ আগেও নানীকে কোলে করে নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে গাড়ীতে উঠানো হলো হাসপাতালে নেওয়ার জন্য | বড় নাতির কোলে করে নানী সেই যে বাসা থেকে বের হলেন— ফিরলেন নিস্তেজ—নিথর হয়ে ! চির দিনের জন্য চলে গেলেন—না ফেরার দেশে |
হ্যাঁ—আমাদের নানীর বয়স হয়েছিল, কিন্তু মানুষের মন কখনো আপনজনকে হারাতে চায় না ! আর তাইতো আমাদের অভিমানী ছোট মামা ( মনু মামা ) তার মায়ের বিছানায় বসে—মায়ের রেখে যাওয়া স্মৃতি খুঁজে ফেরেন ! নীরবে চোখের পানি ফেলেন ! বড় একা হয়ে গেলেন আমার এই অভিমানী মামাটি ! আর সেজ মামা সেতো খানিকটা অসুস্থা ! মায়ের জন্য দোয়া পড়ছেন সারাক্ষণ ।
আমার পাঁচ মামা আর তিন খালা এবং আমার মা—তাদের বাবা-মা’র প্রতি ছিল প্রচন্ড আবেগ তাড়িত —ভালোবাসা ! যদিও নানী’কে তার সব সন্তান ভয় পেতেন খুব | অন্য দিকে তাদের পুলিশ বাবার কাছে ছিল—নানা প্রশ্রয় | নয় ভাই বোনের এই বিশাল সংসার— নানী একা সামাল দিতেন | মানুষকে প্রচন্ড ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল— আমাদের এই নানীর |
মেজ মামা আমাকে একদিন ফোন করে বললেন—তোর নানীর একটা ছবি তুলে দিস, ব্যাংকে লাগবে | আমি শত ব্যস্ততা এড়িয়ে নানীর এই ছবিটি তুলেছিলাম | এই ছবিটা আমার কাছে—এক টুকরো স্মৃতি হয়ে থাকলো | আর উত্তরকালের প্রজন্ম হয়তো—এই ছবিটি দেখে জানবে তাদের অতীত ইতিহাস| এই রকম একজন ছিল—একদিন; সে আর নাই কোন দিন . . .
পুরান ঢাকা | ৪ মে ২০১৮
ছবি: মনিরুল আলম